এই শহরের গান গাই
- চিন্ময় বসু ১৮-০৫-২০২৪

এই শহর, আজকের বর্তমান, পরশুর ভবিষ্যতের কবরে প্রতিদিনের পুনর্জন্ম,জীবন্ত রাস্তা, পার্ক, বাস, ট্যাকসি, সিনেমা, থিয়েটার, বার, হোটেল, পায়রার খোপ, গুপ্ত কুঠুরী কত কি। শহরের এই সাড়ে তিন হাতে অনায়াসে এঁটে যায় ছায়াপথ, আমাদেরকে স্বপ্ন দেখে শহর,আর আমাদের স্বপ্নের গলি ঘুঁজিতে সেই সব ভুত আমরা মীমাংসা করি। স্বপ্নে ঘোরা ফেরা, কি এক আলো।

একটি মাত্র শব্দের মুকুর মায়ায় প্রতি একশো বছরে জেগে যায় নগর, কেউ চেনা নেই বলে ঘুমিয়ে পড়ে। পাশে শুয়ে ঘুমন্ত নারীর আঁখি পল্লব থেকে উঠে, কত মিনার ও ভাস্কর্য আর গল্প গাঁথা, বসন্ত জুড়ে চোখের ভিতর স্থির দৃশ্যগুলি এসে দাঁড়ায়। কত স্কুল, কত কারাগার, শব্দ, হরফ, আখর, সংখ্যার ভিড়,কত দরবার, ও আইন।

নদী সব চার চারটে করে, বাগান, গাছ, বারান্দা, হাওয়ার পোশাকে মানুষ জন, হায় তোরা ফিরে আয়, ফিরে আয়, মাটি কাদা হয়ে। আলোর ভিতর স্নান সেরে আলোর তলায় নিদ্রা যাপন। সময়ের বন্যায় ভেসে, জ্বলন্ত অশথ্থ পাতার মত ঘুরে ঘুরে ঘূর্ণির লাশ টেনে টেনে ফিরে আয় ফিরে, আয় আমরা জেগে না ঘুমিয়ে। আমরা, আর কিছু নই, জাস্ট ভোর,শুধু শুরু সবে এই শহরে আমরা। ছাড়তে পারিনা, শিখিনি, ভেসে উঠি আর আর ধূসর নগরীর ভিড়ে।

তীব্র নগরীর স্মৃতি কথা বলি রোজকার ছোট খাটো সত্যি শুধু দুই, অপর যা তার সবেতে কিছুটা কেটে কেটে ভাগ করে নিজেকে বিলিয়ে ভেসে আছি।
মৃতদের গড়া এই শহরের সাথে কথা বলি, অনিবার্য ভূতেদের সাথে, স্মৃতিতাড়িত অন্ধ চলাফেরা, চুপ করে মনের ভিতরে কথা বলা আর এইসব বলে বলে ঘুম কেড়ে নেয়, আমি যত গম্বুজ, ইট, কাঠ, ব্রীজ, পাতাল রেলের আর বিশাল গুদামের ঘর পার হয়ে, সর্বনাশ, বিস্ময় ও ধ্বংস, চরম বিমূর্ত দেশ, কঠিন কংক্রিট, থানাদার, জেলখানা, ধর্ম প্রচারক, একটা দোকান ছিল সব পাওয়া যেত, আমরা সব হারিয়ে ধোঁয়ায় মিলানো ।

বাজারের ভিতর, মিশ্র আলো,ফলের পিরামিড, ঋতুর পরিবর্তন, হুক আর ফাঁসে দোলা খাসি, মসলার পাহাড়, জার বয়াম, ও আচারের স্তম্ভ, মিশ্র গন্ধ,ও রং, বস্তু, গলার আওয়াজের জোয়ার ভাটা,জল,ধাতু,কত কাদামাটি, মানুষের সারি, দর কষাকষি, সকাল শুরুতেই, গোপন ফাঁদ, বর্ণনা করে যাই। ইট পাথরের বাড়ী,সিমেন্ট,কাঁচ, লোহা, ও হলঘরে জনতা পোর্ট ও সভাস্থলে, থার্মোমিটার পারার মত লিফটের ওঠানামা শহর জুড়ে। ব্যাংক ও কর্পোরেট, শাসকের সমিতি, কারখানা ও ম্যানেজার,শ্রমিক ও ছেনাল যন্ত্র।
কামনা ও পৌনপনিকতার ধীর্ঘ রাস্তা ধরে বেশ্যাবৃত্তির অমর কুচকাওয়াজ, গাড়ির যাওয়া আসা, আমাদের প্রযত্নের আয়না, থোর বড়ি খাড়া, ও আসক্তি,কেন কিসের কোথায়।

হাসপাতাল সর্বদা মানুষে ভর্তি, যেখানে আমরা একাকী মারা যাই। বলে যাই কিছু উপাসনা গৃহের বিষাদের কালো ছায়া, স্থির প্রদীপ শিখার অন্তর কম্পাঙ্ক। স্তিমিত ভাষা, গৃহহীন মানুষের,আর সাধুর সাথে আবার কুমারীর সাথে আগুন ঝরা চাঁচাছোলা ভাষায়। এক চক্ষু আলো, ভাঙ্গা টেবিল ও কোনভাঙা প্লেটে রাতের খাবারের কথা বলি, অবুঝ নিরপরাধ উপজাতীয় যাদের খাস জমিতে বসবাস স্ত্রী পুত্র, ও পশু পাখি নিয়ে আর ইদুরের বাড়ী ঘর ভিতে, জীবন্ত ইলেক্ট্রিকের তারে সাহসী চড়ুই এর বাসা, শ্মশানে গাছের মৃতদেহে।

বিচক্ষণ বিড়াল তাদের রাজকীয় হাবভাব, চাঁদের আলোয়, ছাদের নিষ্ঠুর দেবী, রম্য কুকুর, আমাদের সন্ত সন্ন্যাসী, যে কুকুর মাটি খুঁড়ে সূর্যের অস্থি তুলে আনে। আমি বলি আতঙ্কবাদীর ভালোবাসা ও ভাইচারা পেরিয়ে,ন্যায়বাদীর ষড়যন্ত্র ও ডাকাতের যুথবদ্ধ অভিযান, অপরাধীর বন্ধুত্ব ও সঙ্ঘ, আত্মহত্যাকারীর দল ও ধর্ষকের খ্যাতি, মানুষের বন্ধু, ফাঁসির দড়ির পরীক্ষক, সিজারের পতন, মানুষের লিঙ্গানন্দ ।

আমি বলি অবশ অঙ্গ প্রতিবেশীর কথা, আহত দেওয়াল,শুষ্ক ঝর্না, রং করা ভাস্কর্য, পাহাড় প্রমাণ ডাই করা আবর্জনা, পলাতক সূর্যর নোংরাতে গলে যাওয়া দেহ। ভাঙ্গা কাঁচ, বর্জিত মরুভূমি, গত রাতের অপরাধ, প্রেসিডেন্টের ব্যানকুয়েট পার্টি, টিভির ডিসের ওপর মরা চাঁদ, নোংরা নৌকোয় প্রজাপতি।
আমি ভোরের ঠান্ডা হ্রদে উড়ে যাওয়া মরাল, তাদের স্বছ ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলা উত্তম আকাশচুম্বি প্রাসাদের কার্নিশে আর পাথরের পাতায় পাতায় মেলে ধরা সভ্যতার কথা বলি।

আমি বলি শরৎকালের শুরুর সূর্যাস্তের রঙের কথা তার সোনালী বিক্ষেপ, বিশ্বের রূপান্তর, সব কিছু বিমূর্ত, ভাসমান, চিন্তিত আলোয়,আমাদের প্রতিফলন, আর সময়ের খেই হারিয়ে হাওয়া বাতাসে মেশা গ্রীষ্মের কথা, অবকাশের রাত, দিকচক্রবালে জেগে উঠে ধোঁয়ার পাহাড়ে আমাদের ওপরে যা ভেঙে পড়ে ঢেউ এর মতন।

নতুন চেনা বস্তুতে,সাগরের মত বয়ে যাওয়া নদী ঘুমায়, আমরা তার শ্বাসের সাথে দুলে উঠি, যেখানে সময়কে ছোঁয়া যায় ফলের মতন। আলো জ্বলে ওঠে, রাস্তায় কামনার আলো, পার্কে বিদ্যুতের আলো পড়ে, পাতার ভিতর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসে, সবুজ চকচকে ইলশে গুড়ি বৃষ্টির মত নামে আলোকিত করে , ভিজি না, গাছ ফিস ফিস করে, কিছু বলে।
আরও আছে নিথর দুঃখিত পট স্মিত হেসে জেগে থাকে, কোথায় চলে যায় জানিনা, নিরুদ্দেশ দ্বীপের পারা ঘাটায়।

উঁচু বাড়ির ওপরে তারারা দুর্বোধ্য বাক্য লিখে রাখে পাথর আকাশে। হঠাৎ নামা বৃষ্টি কেমন কাচের জানালাতে চাবুক মারে, কেমন গাছকে বিব্রত করে, পঁচিশ মিনিটে বৃষ্টি থামলে,আকাশের নীল ছিদ্র ভেদ করে আলোর ফোয়ারা নেমে এলে, রাস্তার গরম পীচ থেকে ধোঁয়া ওঠে, গাড়ী ঝলকায়, রাস্তার জমা জলে রাজার প্রাসাদ, যাযাবর মেঘ, পাঁচ তলার ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসা রহস্যময় পাতলা হাসি যেন দূরের শিকড় প্রণালীতে ভেসে আসা আর্দ্রতা। আমি আরো দেখি অচেনা আমার ব্যবহার আর তার অজ্ঞাত ফলাফল আর তার বিধ্বংসী রূপ।

রাতের খোলা চোখ আর দিনের জাগিয়ে তোলা দেখি, বিস্তৃত সমুদ্র, আগুনের বাণী, সাহসী বক্ষ: চাঁদের জোয়ার, চিচিং ফাঁক ঠোঁট, উন্মুক্ত সময়, ছোট ঘর কেমন পিউপার রূপ বদলের কক্ষ হয়ে ওঠে। হাওয়া আর আগুনে মিশে কেমন জল আর মাটিকে গুলিয়ে দেয়। আবার কখন এমন সময় আসে এই চেনা সময়েই কেমন তালা লেগে যায়, সময় স্থির দাঁড়ায়। হিক্কা থেমে যায়,কান্না ও আর্তি থামে, আত্মা শরীর ছেড়ে দেয়,মেঝে দিয়ে গড়িয়ে নামে, গুটিয়ে যায়।, আমরা অন্তহীন বারান্দায় হেঁটে যাই, বালিয়াড়িতে আমাদের শ্বাস ওঠে, ওই গান কি মিলিয়ে যাচ্ছে না আসছে,আর ওই ধূসর আলো জ্বলছে না নিভে যাচ্ছে, শূন্যে গান ওঠে সময় অদৃশ্য হয়, শ্বাস, দৃষ্টি দেওয়াল বেয়ে নেমে গেলো, নিশ্চুপ দেওয়াল, দেওয়াল। আমি জনতার ইতিহাস, ব্যক্তিগত ইতিহাস, তোমার আমার বর্ণনা করি। পাথরের জঙ্গল, জ্ঞানীর মরুভূমি, আত্মার কংক্রিট মিক্সার, উপজাতির সঙ্ঘ, আর্সির ঘর, প্রতিধ্বনির প্রতিটি কোন ও আনাচকানাচ বর্ণনা করি।

সময়ের অন্ত্স্থল থেকে উঠে আসা মহান কেচ্ছা, জাতির অসংলগ্ন প্রলাপের ফিসফাস জমে ওঠা বা ঠিকরে যাওয়া বলে যাই। বলে যাই জনতার সারি, খাড়া উল্লম্ব ছিটকে যাওয়া অস্ত্র শস্ত্র, হাড়ের বধির উল্লাস ইতিহাসের গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়া।

আমি বলে যাই শহরের মেষপালিকা উষ্ণ নরম নারীর কথা,এক অসহায় মায়ের কথা যে আমাদের নিয়ে আসে, গিলে খায়, আবিষ্কার করে ও ভুলে যায়।

২০/১২/২০১৯

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 1টি মন্তব্য এসেছে।

M2_mohi
১০-০৬-২০২০ ১৩:১৩ মিঃ

Excellent